আজম জহিরুল ইসলামঃ সামনে কোরবানির ঈদ। গ্রামের এক ধনাঢ্য কৃষক স্থানীয় হাট থেকে এক লাখ টাকা দিয়ে একটি মোটাতাজা গরু কিনে আনলেন। পবিত্র ঈদের দিন বাড়ির সামনে সেটি জবাই করা হলো। গরু জবাই শেষে চামড়াটি রাখা হলো মাংসের স্তূপের একপাশে। হঠাৎ চামড়া ও মাংস নড়েচড়ে উঠলো। তারা পরস্পর বন্ধুর মতোই কথা বলতে শুরু করলো।
: জানিস চামড়া, আমার গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমি বহু গুণের অধিকারী। হি. হি. হি.।
: শুধু তোর গুণের কথা বলছিস। চামড়া বলে কী আমার কোনো গুণ নেই?
চামড়ার কথায় মুখ কালো করলো মাংস। বললো, ‘তুইতো চামড়া। তোর আবার গুণ কিসের?’
: দেখ মাংস। আমাকে নিয়ে মস্করা করবি না বলে দিলাম। আমরা একই দেহে একই সাথে জড়াজড়ি হয়ে বাস করি। তোর সুরক্ষার জন্য আমি কি না করছি? আর তুই কিনা আমার গুণ নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিস?
: তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবো কেনো? যা সত্য তাই প্রকাশ করছি।
: করবিইতো। তোর চেহারাটাতো মাশাল্লাহ সুন্দর, লাল টুকটুকে।
: আমি চেহারার কথা বলছি না, বলছি গুণের কথা। তাহলে তোর গুণের কয়েকটি উদাহরণ দে শুনি?
: ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ আছে আমার। এই মনে কর, আমি বেল্ট হিসেবে মানুষের কোমড়ে জড়িয়ে থাকি। মেয়েরা চামড়ার তৈরি ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। আর…।
: আর কি দোস্ত?
: চামড়া দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানি সুন্দর সুন্দর জুতা তৈরি করে। আর সেই জুতা মানুষ পায়ে পরে।
চামড়ার কথা শুনে মাংস হো. হো. করে হেসে উঠলো। তার যেনো হাসি কিছুতেই থামতে চায় না। মাংসের এহেন কা- দেখে ধমক দিয়ে উঠলো চামড়া।
: এই, তুই দাঁত বের করে অমন করে হাসছিস কেনো? এটা কোনো হাসির ব্যাপার হলো?
: হাসির কথা নয়তো কী? তুই থাকিস মানুষের পায়ের নিচে। আর এই নিয়ে গুণের বড়াই করছিস?
: তুই মানুষের পায়ের নিচেরটাই দেখলি? পায়ের উপরেও যে আমি থাকি সেটা স্বীকার করবি না?
: করবো, করবো। এবার তাহলে আমার গুণের কথা শোন। আমার স্বাদের কথা কে না জানে? প্রায় লোকের খাবার টেবিলেই আমি থাকি। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলেই আমাকে পছন্দ করে। বড়লোকরা তো প্রতিদিনের খাবার তালিকায় আমাকে সযতেœ রাখে। আহা, আমার কী দাম! কী সম্মান!! আমাকে কিনতে গিয়ে অনেকেই দোকানে লাইন দেয়। শুধু স্বদেশ নয়, বিদেশেও রয়েছে আমার প্রচুর চাহিদা।
মাংসের কথায় চামড়ার গায়ে জ্বালা ধরে গেলো। মুখ ভেংচিয়ে বললো, ‘নেতাদের মতো সেই কখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছিস। আমাকেও বলতে দে।’
: তুই ঠিকই বলেছিস। আমি নেতাদের মতো বেশি কথা পছন্দ করি। আমার আরেকটি গুণের কথা শোন চামড়া। আমাকে (গরু) এই বাড়ির ধনী কৃষক এক লাখ টাকা দিয়ে কোরবানির হাট থেকে কিনে এনেছে। আর আমার এই মাংস ঈদের দিনসহ গোটা কয়েক দিন ধরে মানুষ আয়েশ করে ভক্ষণ করবে।
মাংসের কথা শুনে মাথা ঠন ঠন করতে লাগলো চামড়ার। কিন্তু তাকে কথা বলতেই দিচ্ছে না মাংস।
: জানিস, বাজারে আমার কতো দাম? আমার শরীরের সামান্য অংশের (এক কেজি) দাম সাড়ে পাঁচশ’ থেকে ছয়’শ টাকা। সেই হিসেবে তুই আমার নখের যোগ্যই নস।
মাংসের হামবড়া কথা শুনে চামড়ার গায়ে যেনো ফোস্কা পড়ে গেলো। মুখ ভেংচে ধমকের সুরে সে বললো, ‘দেখ মাংস। তুই আমাকে নখের সাথে তুলনা করবি না। চামড়ার তৈরি জিনিসের দাম শুনেতো তুই হার্টফেল করবি। তোর এক টুকরো অংশের দাম মাত্র পাঁচ-ছয়’শ টাকা। চামড়ার তৈরি জুতা জোড়ার দাম কতো জানিস? লাখ টাকা। আর একটি ভ্যানিটি ব্যাগের দামও লাখ টাকার উপরে। তোর দাম নিয়ে অযথা বড়াই করবি না বুঝলি?’
চামড়ার কথা শুনে মাংসের মাথায় যেনো বাজ পড়লো। সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বললো, ‘তোর যে কেমন দাম এবার কোরবানির ঈদেই সেটা বোঝা গেলো। ছি. ছি.। তোর দাম এতো সস্তা! আমি বাপের জীবনেও এমন কেলেংকারীর কথা শুনিনি।
ওদের বাক-বিত-ার এক পর্যায়ে একজন চামড়া ক্রেতা এসে হাজির হলো। তাকে দেখে মাংস বললো, ‘এই চামড়া, চুপ চুপ। তোকে কিনতে একজন বেপারী এসেছে। চল আমরা কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করি।’
চামড়ার দরদাম করে বনিববনা না হওয়ায় বেপারী অন্য জায়গায় চলে গেলো। এবার মাংস ও চামড়া সরবতায় ফিরে এলো।
: দেখলিতো চামড়া। বেপারী তোর দাম কতো বললো? মাত্র তিনশ’ টাকা। আর পাশেই যে ছাগল ভাইয়ার একটা চামড়া স্তূপাকারে পড়েছিলো সেটার দাম বললো মাত্র দশ টাকা? হায় হায়! দেশটা কী মগের মুল্লুক!!
মাংসের কথা শুনে চামড়ার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে কাতর কণ্ঠে বললো, ‘আমার মালিকের কথাও শুনলাম। তিনি বলছেন, লাখ টাকার গরুর চামড়ার দাম মাত্র তিনশ’ টাকা? প্রয়োজনে চামড়া মাটির নিচে পুতে ফেলবো। নয়তো নদীতে নিক্ষেপ করবো। তবু আপনার কাছে চামড়া বিক্রি করবো না। মালিকের কথা শুনে আমারতো ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মাংস ভাই।’
: কেনো, তোর আবার কষ্ট কিসের? কষ্টতো মালিকের হওয়ার কথা।
: মালিকের চেয়ে আমার কষ্ট হচ্ছে বেশি। কারণ, মালিকতো আর চামড়া বিক্রির টাকা নিজে খরচ করবে না। ওই টাকা গরিব-মিসকিন বা এতিমদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। কিন্তু এবারতো আর সেটা হবে না মাংস ভাই।
: তুই ঠিকই বলেছিস চামড়া। আজ সারা দেশের একই চিত্র। কোথাও চামড়ার দাম নেই। অনেকে পানির দরে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
: আচ্ছা এ রকম কেনো হলো দোস্ত? আগেতো এমনটা ছিলো না।
: শুনলাম, এটা নাকি সিন্ডিকেটের কারসাজি। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি সিন্ডিকেট তৈরি করে চামড়ার দামে ধস নামিয়ে দিয়েছে। ফলে ঠকেছে গরিব-মিসকিন ও এতিমরা।
: সিন্ডিকেটের বিচার হওয়া উচিত। ওদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। আমি ঠিক বলিনি মাংস ভাই?
: তোর কথা ঠিকই আছে। কিন্তু কে করবে কার বিচার? কথায় বলে না, ‘বিচারের বাণী নিরবে-নিভৃতে কাঁদে।’
****************************************
আজম জহিরুল ইসলাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, গৌরীপুর লেখক সংঘ, ময়মনসিংহ।
তারিখঃ ১৪/০৭/২০২১ইং।