হলুদিয়া পাখি ও ফাল্গুন।।✍️লাবণ্য কান্তা✍️ ঢাকা।

গল্প সাহিত্য সাহিত্য-সংস্কৃতি
Share on Social Media
 
    
   

লাবণ্য কান্তা, ঢাকা: তখন করোনাকাল, মার্চ মাসের শেষের দিকে করোনা যখন প্রাণ কেঁড়ে নিচ্ছে অবিরাম। মানুষ মরছে, মানুষ মৃত্যুর প্রহর  গুনে গুনে ক্লান্ত হচ্ছে তখন রাস্তা-ঘাট নির্জন, দোকানপাট বন্ধ।  রাজপথ শূন্য, চারদিক হাহাকার এ কোন মহামারি এলো পৃথিবীময় শুধু লাশ আর লাশ। মানুষ মরে যাচ্ছে সারি সারি, মানুষের মৃত্যুতে মানুষ কাঁদতেও ভুলে গেছে, কে জানাবে কাকে দুঃখ-শোকে  সান্ত্বনা!মানুষ নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত তখন অন্যের বাঁচা- মরা নিয়ে ভাবনার সময় যে নেই যেমন তেমনি নেই সুযোগ। প্রতিটি মানুষ গৃহবন্দি। চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ তখন পাখপাখালি, কুকুর বিড়ালের বড় দুর্দিন এসেছিলো। মানুষের জন্যও দুর্দিন ছিলো। পুরো পৃথিবীটার জন্যই দুর্দিন করোনা নামক এই মহামারি। মানুষের জন্যই পাশুপাখি বাঁচে আবার মানুষের জন্য পশুপাখি বিলুপ্তও হয়;  কিন্তু করোনাকাল হয়তো প্রমাণ করেছে পশুপাখিরা মানুষের ওপর কতটা নির্ভরশীল!গল্পটিতে ঢাকার কথা বর্ণনা করা হচ্ছে। ঢাকা যখন নিস্তব্ধ চারদিক খা খা করছে তখন হোটেল রেস্টুরেন্ট বন্ধ, পথের ধারে চায়ের দোকান বন্ধ, ডাস্টবিনে বাসি খাবার নেই, পশুপাখির নাড়িভুড়ি নেই, পাখপাখালির বাঁচা বড় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।কি খাবে তারা ? গাছের ফল ঢাকা শহরে আর কটাইবা আছে!তখন সারাদিনরাত পথে কুকুরের কান্না শোনা গেছে।বিড়ালের কান্না শোনা গেছে। সারাদিন পাখিদের কান্না শোনা গেছে।কত দূর-দূরান্তের পাখির দল এসেছে গাছে গাছে।খাবার না পেয়ে পাখির কান্নায় ঝনঝন করেছে নীরব সময়।পাখির অবিরাম কান্নায় ঘরে থাকাটা কষ্টের হয়েছিলো। এত পাখি, এত রং-বেরঙের পাখি, এত চেনা-অচেনা পাখি। খাবারের অভাবে গাছের ফুল খেয়ে ফেলেছে পাখির দল, ফুলের বীজ, তুলসীমঞ্জরী পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছে। ঘরের ভেতরে অনায়াসে প্রবেশ করেছে খাবারের জন্য।সেই সময়ে অনেক হলুদিয়া পাখি এসেছিলো অতিথি পাখিদের মত পাখিদের ভিড়ে।এই হলুদিয়া পাখিদের কান্না সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিলো।তাদের ডাকও অন্যরকম।তাদের ডাক এবং তাদের কান্না অন্য পাখিদের থেকে অনেক পার্থক্য।

এই পাখিগুলো কোনো গাছের ডালে বসে কখনোই গান গায় না; এমনকি কাঁদেও না।  এই পাখিরা উড়ে উড়ে গান করে যেমন _তেমনি কান্নাও করে উড়ে-উড়েই।

এই হলুদিয়া পাখির নাম কাঠঠোকরা। এই পাখিরা গাছের শক্ত ডালের পোকামাকড় আর পিঁপড়া খায়। সারাক্ষণ কাঠে ঠোকর দেয়। অনেকগুলো হলুদিয়া পাখি ছিলো কয়েকমাস জুড়ে। তাদের কান্না, তাদের ডাকে সরব হতো নিস্তব্ধ মহামারিকালের সকাল-দুপুর-বিকেলগুলো।পাখিদের এমন কান্না কখনোই শুনিনি এমনভাবে। করোনা মহামারী শুধু মানুষকেই কাঁদায়নি, কাঁদিয়েছে পশু-পাখিদের।কে জানে কত পাখি এইভাবে হয়তো মরেও গেছে না খেয়ে। অনেকদিন ছিলো পাখিগুলো। তারপর যখন কিছু মানুষজন বের হতে শুরু করেছে ঘর থেকে, কিছু দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে, তখন আস্তে আস্তে পাখিদের ভিড় কমতে থাকে। তারাও মানুষের মত এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে শুরু করলো।তারপর কিছুদিনের মধ্যে সেই পাখিগুলো নিজেদের ঠিকানায় হয়তো চলে গেছে। তারা অতিথির মতো অনেকদিন ছিলো। তাদের নিজের ঠিকানা আছে কিনা তা জানা নেই।কিন্তু তারা হারিয়ে যেতে থাকে; তাদের সাথেই সেই হলুদিয়া পাখিগুলোও হারিয়ে গেলো। করোনাকালের সারাক্ষণের সঙ্গী এরা; অথচ কিছু না বলে কয়ে চলে গেলো কোন অজানার উদ্দেশে। গাছের ডাল, গাছের পাতা-ফুল-ঝিরিঝিরি হাওয়াও তাদের খুঁজতে থাকে আমার মতো। আমি যেভাবে যখন তখন তাদেরকে খুঁজতাম পাতার আড়ালে, ফুলের আড়ালে তেমনি।কিন্তু না, কোথাও আর দেখা গেলো না তাদেরকে একেবারেই হারিয়ে গেলো।

সেই হলুদিয়া পাখিদের মাথার লাল ঝুঁটি আর  নিখাদ হলুদ রঙের দুটি ডানা কী যে অপরূপ! এত কাছে থেকে না দেখলে হয়তো এমন বর্ণনা করা অসম্ভব হতো। কী যে আশ্চর্যরকম কাঁচা হলুদের মতো সেই হলুদিয়া রঙের ডানা কোনোমতেই তাদেরকে ভোলা যাচ্ছিলো না। সাদা-কালো পালকে ঢাকা তাদের পুরো দেহ, চোখ কালো, ঠোঁট কালো, পা কালো কেবল মাথার ঝুঁটিটাই লাল। সাদা-কালো-লাল-হলুদ সব রং মিলিয়ে আশ্চর্য সুন্দর এই পাখি দুটো যখন এসে বসতো শুকনো ডালে ঠিক মুখোমুখি; __

যেন কতদিন তাদের দেখা হয়নি,

কতদিন কোনো কথা বলা হয়নি।

এইভাবে মুখোমুখি বসে কত যে

কথার কথা তাদের হতো বিনিময়।

আমি তখন নির্বাক বোকা সত্যি যেমন

প্রশ্ন জাগে মনে কী কথা তাদের এতো?

তাদের হলুদিয়া ডানার হলুদ আভায়

ভরে যেতো ডাল-পালা ইন্দ্রজালের মতো।

তখন খুব চেষ্টা করতাম তাদের একটি ছবি তুলি, জানালার বাইরে হাত বাড়াতেই পাখি দুটো উড়ে যেতো কোন সুদূরে …

আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় …প্রশ্ন করেছি নিজেকে নিজেই মনের অজান্তে সঙ্গীতশিল্পী হেমন মুখোপাধ্যায়ের গানের কথার মতো করে___

“তোমারই ধ্যানে ক্ষণে ক্ষণে কত কথা জাগে মোর মনে।

চোখে মোর ফাগুনের ছবিতে আঁকো, কেন দূরে থাকো?”

সত্যি তো তাদের হলুদিয়া ডানায় আর লাল মাথার ঝুঁটিতে ফাগুন যেন থমকে থাকে অবিরত। পাখি দুটো অনেক কথা বলতো দুজন দুজনের সাথে। পাখিদেরও অনেক কাজ থাকে, তারাও সারাক্ষণ ব্যস্ততায় কাটিয়ে দেয় সারাবেলা। তাদেরও ঘর-সংসার থাকে, তারাও সারাদিন চিন্তায় থাকে, কখন কোন কাজটি করতে হবে। কখন একটি একটি করে খড়কুটো যোগাড় করতে হবে, নিজের হাতে বাসা বানাতে হবে, ডিম পাড়তে হবে, ডিমে তাপ দিতে হবে, বাচ্চা ফোটাতে হবে, বাচ্চার জন্য খাবার-জল সংগ্রহ করতে হবে। বাচ্চাদেরকে অন্য আক্রমণকারী পাখিদের থেকে বাঁচাতে হবে। নিজেদের প্রাণের রক্ষা করতে হবে। এত কাজও তাদের!

এতো কাজের পরেও তাদের খড়কুটোর বাসাটি হয়তো একদিন ঝড়ে উড়ে যায়, হয়তো ঝড়ের সঙ্গে তাদের ডিমও হারিয়ে যায়; আবার এমনো তো হতে পারে ডিম রেখে মা পাখিটি বাইরে গেছে হয়তো কোনো শিকারির শিকারে পরিণত হয়।হয়তো এমন অনেককিছুই ঘটে, হয়তো তার চেয়েও তাদের বেঁচে থাকাটা আরো বেশি কঠিন।

পাখি দুটো এইভাবেই ভাবনাতে ভর করে থাকে। এমন কথাগুলো মনের ঘরে ঘুরপাক খায়, তারপর একটা সময় লকডাউন সীমিত হয়ে আসে, সেই হলুদিয়া পাখিগুলো হারিয়ে গেলো। অনেকদিন তাদেরকে আর কোথাও দেখা যায়নি।কি করা আর!

গান … আমাদের মাটির গান, আমাদের শিকড়ের গান, আউল-বাউল-লালনের গান কখনো কখনো খুব নিখাদভাবে মনকে নাড়া দেয়।

“কেউ না জানিল, কেউ না দেখিল,

কেমনে পাখি দিয়া যে ফাঁকি

উইড়া গেল হায় চোখের পলকে।

পাখিটি ছাড়িল কে ।

হলুদিয় পাখি সোনারই বরণ

পাখিটি ছাড়িল কে?”

দিন যায়, রাত চলে যায়, মাস আসে মাস ফুরায়। পাখি দুটো কোন বনে উড়ে গেল?কেটে গেছে তারপর কতটা দিনরাত, এবং তারপর?

তারপর! তারপর আবার এসেছে ফাগুন।সজনে ফুলে ভরে গেছে সজনে গাছ, বাতাবীফুলের সুরভি ভাসে উত্তরের হাওয়ায়।আম্রমঞ্জরীতে ভ্রমরের গুঞ্জন, দেবদারু গাছে মৌচাকে মধু জমেছে, রাণী মৌ্মাছিকে ঘিরে কত গুনগুন। মৌয়ালের চোখ গাছে গাছে খুঁজে ফিরছে মধুর চাক। দেবদারু গাছের ফল পেকে কালো হয়ে গেছে, ধুলোয় ঢাকা ধূসর প্রকৃতি সজীব হতে শুরু করেছে।এসবের সাথে একাত্ন হতে সেই হলুদিয়া পাখি দুটো আবার এসেছে ফিরে হলুদ ডানায় ফাগুনকে সঙ্গে নিয়ে।এসেছে বসন্ত পঞ্চমী, এসেছে ফাগুন, এসেছে বসন্ত, ডাকছে কোকিল, এসেছে হলুদিয়া পাখিও ফিরে।

জীবনানন্দের মতো বলে যায়নি তারা, “ আবার আসিব ফিরে” কিন্তু তারা আবার এসেছে ফিরে, আবার গান শোনাতে ব্যস্ত, আবার তারা তাদের ঘর-সংসারের কথা বলে মুখোমুখি বসে। আতা গাছে আতা পেকেছে অনেক। সারাদিন শালিক-চড়ুই নাম নাজানা অনেক পাখিরা আতাফল খায়, হলুদিয়া পাখি দুটো আতাফল খায় না; সারাক্ষণ কাঠে ঠোকর দিতে ব্যস্ত আর ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে ফাগুনের আহ্বান জানায় __ তাদেরই লাল-হলুদ রঙে ভর করে বসে আছে ফাগুন যেন তাদের হলুদিয়া ডানায়।

✍️লাবণ্য কান্তা✍️ঢাকা। ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২১।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *