শেখ এহিউল ইসলামঃ ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস। ম্যানগ্রোভ বনের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং এর প্রতিবেশ সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে এ বছর দিবসটি পালিত হচ্ছে। ইকুয়েডরে ম্যানগ্রোভ কেটে চিংড়ি চাষ করার প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুলাই আয়োজিত সমাবেশে একজন অংশগ্রহণকারীর মৃত্যু হয়। সেই থেকে তাঁর স্মরণে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ দিবসটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, পৃথিবীতে ১,৮১,০০০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বিস্তৃত ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এ বনাঞ্চলের আয়তন ১,৫০,০০০ বর্গ কি.মি. এর নিচে নেমে এসেছে। সমগ্র পৃথিবীর উপকূলীয় এলাকা অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হতে অতিরিক্ত কাঠ ও মাছ আহরণের ফলে এবং উপকূলীয় ভূমিকে বিকল্প ব্যবহার যোগ্য ভূমি হিসেবে ব্যবহারের ফলে এ বনাঞ্চল হুমকির সম্মুখীন। সারা পৃথিবী ব্যাপী গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের উষ্ণ ও উপউষ্ণ (Tropical and Sub-tropical) উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ জাতীয় বনাঞ্চল দেখা যায়।
বাংলাদেশের সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে পরিচিত। সুন্দরবন বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের থেকে জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলেমিটার জায়গাজুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত। বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের উদ্ভিজ্য বড় বৈচিত্র্যময়। ডি প্রেইনের ১৯০৩ সালে প্রকাশিত তথ্যমতে এখানে ৩৩৪ প্রজাতির ছোট বড় বৃক্ষ, গুল্ম, লতা, পরজীবি উদ্ভিদ ও শৈবাল রয়েছে। ১৯৮৫ সালে ওডিএ ৬৬ টি উদ্ভিদ তালিকাভুক্ত করে। তবে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক ১৩০ টি সচারাচর দৃশ্যমান উদ্ভিদ প্রজাতি এখানে রয়েছে। এ বনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৃক্ষ প্রজাতি হলো সুন্দরী। আরো রয়েছে কেওড়া, বাইন, পশুর, গোলপাতা, গরান, কাঁকড়া, খলসী, হেঁতাল, ধুন্দুল, কিরপা, সিংড়া, বলা, ঝানা ইত্যাদি।
সুন্দরবনের পরিবেশগত গুরুত্ব অপরিসীম। এ বিশাল আয়তনের ম্যানগ্রোভ বন বাতাস থেকে অধিক মাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নিজ দেহে মজুদ রাখতে সক্ষম। এর মধ্যে কেওড়া গাছ সর্বাধিক কার্বন এর শিকড়, কাণ্ড, ডালপালা ও পাতায় মজুদ রাখতে পারে। এক হেক্টর কেওড়া বন বছরে ১৭০ টন পর্যন্ত কার্বন মজুদ রাখতে পারে। বাইনের ক্ষেত্রে তা ১১৫ টন, গেওয়ায় ২৩ টন। এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে মোটামুটি ৬৬২ কোটি টন কার্বন মজুদ আছে।
সুন্দরবন উত্তর ও দক্ষিণে ১০০ কিলোমিটার এবং পূর্ব ও পশ্চিমে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে এ বিশাল আয়তনের বন জীবন্ত প্রাচীর হিসাবে বা গ্রীন সেল্টারবেল্ট হিসাবে সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তান্ডব থেকে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জনপদকে যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে আসছে।
সুন্দরবন অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ বন্যপ্রাণির অন্যতম আবাসভূমি। এ সকল বন্যপ্রাণি বাংলাদেশের এক অমূল্য সম্পদ। বনের সার্বিক পরিবেশ সংরক্ষণে এরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। এখানে ৪৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণিসহ মোট ৪০৭ প্রজাতির বন্যপ্রাণি রয়েছে। পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাস এখানেই। আরো উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণি হচ্ছে হরিণ, বানর, শুকর, কুমির, ডলপিন, গুইসাপ, অজগর, বালিহাঁস, হরিয়াল, গাংচিল, বক, মদনটাক, চখা, চিল ইত্যাদি। সুন্দরবনের নদী-নালায় রয়েছে ৫৩ প্রজাতির সমুদ্রচর মাছ, ১২৪ প্রজাতির সাদা মাছ, ২০ প্রজাতির চিংড়ি, ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, ৮ প্রজাতির লবষ্টার ইত্যাদি। সবমিলিয়ে সুন্দরবন বিশ্বের মধ্যে জীববৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ম্যানগ্রোভ বন।
এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলীয় এলাকায় বন বিভাগ ২ লক্ষ হেক্টর কৃত্রিমভাবে ম্যানগ্রোভ বন সৃজন করেছে। যা পৃথিবীর মধ্যে মনুষ্যসৃষ্ট মডেল ম্যানগ্রোভ বন। এ বনের ৯০% উপরে কেওড়া প্রজাতি। দ্বিতীয় সফল প্রজাতি বাইন। গেওয়া আছে সর্বত্রই। বর্তমানে উপকূলীয় বনে গেওয়া রিজেনারেশনের আধিক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন আজ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি, পানি দূষণ, দুর্ঘটনা, তেলদূষণ, শব্দদূষণ, নদীতে পলি পড়া, আগুন লাগা, অবৈধভাবে গাছপালা কর্তন, অবৈধ অনুপ্রবেশ, আর সুন্দরবনের আশেপাশে শিল্পকারখানা স্থাপনের কারণে সুন্দরবন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আমাদের সকলকে দেশের ঐতিহ্য সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য সচেতন হতে হবে, একযোগে কাজ করতে হবে।
শেখ এহিউল ইসলাম, কাটেংগা, তেরখাদা, খুলনা।
তারিখঃ ২৯/০৭/২০২০ইং।